ইসলামে যিনা একটি হুদুদ আইনের শাস্তিযোগ্য পাপ অথবা আল্লাহর বিরুদ্ধাচারকারী একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।[১১] কুরআন এবং হাদিসসমূহে এটি উল্লেখিত রয়েছে। কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, যে কোন প্রকারের যৌন ক্রিয়াকলাপ যা বৈধ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ব্যতীত সম্পাদিত হয় সেগুলো যিনা বলে গণ্য হবে, এবং তা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্য সমানভাবে শাস্তিযোগ্য।
কুরআনের বেশ কয়েকটি জায়গায় যিনা সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রথমটি হল কুরআনের সাধারণ নিয়ম যেখানে মুসলিমদের যিনায় লিপ্ত না হতে আদেশ দেয়া হয়েছে:
“তোমরা যিনার ধারে কাছেও যেয়ো না: কারণ এটি একটি লজ্জাজনক ও নিকৃষ্ট কর্ম, যা অন্যান্য নিকৃষ্ট কর্মের পথ খুলে দেয়। ”
—
কুরআন, সূরা ১৭ (আল-ইসরা/বনি ইস্রাঈল), আয়াত৩২[১২]
কুরআনের পর ইসলামের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পাণ্ডুলিপি উৎস হাদিসে যিনাকে সঙ্গায়িত করা হয়েছে সকল প্রকারের বিবাহবহির্ভূত যৌনসঙ্গম হিসেবে।[১৩]
আবূ হুরায়রা সুত্রে মুহাম্মাদ (সাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ আদম সন্তানের উপর যিনার যে অংশ লিপিবদ্ধ আছে তা অবশ্যই সে প্রাপ্ত হবে। দু-চোখের যিনা হল (নিষিদ্ধ যৌনতার প্রতি) দৃষ্টিপাত করা, দু’কানের যিনা হল শ্রবণ করা, রসনার যিনা হল কথোপকথন করা, হাতের যিনা হল স্পর্শ করা, পায়ের যিনা হল হেঁটে যাওযা, অন্তরের যিনা হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা ও কামনা করা। আর যৌনাঙ্গ অবশেষে তা বাস্তবায়িত করে অথবা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে।
ব্যভিচার ও পরকীয়া
কুরআনে সর্বপ্রথম সূরা নিসায় যিনার শাস্তি সম্পর্কিত সাময়িক অস্থায়ী নির্দেশনা অবতীর্ণ করা হয়।
“আর নারীদের মধ্যে যারা ব্যভিচারিণী তাদের বিরুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে চার জন পুরুষকে সাক্ষী হিসেবে তলব কর। অতঃপর যদি তারা সাক্ষ্য প্রদান করে তবে সংশ্লিষ্টদেরকে গৃহে আবদ্ধ করে রাখ, যে পর্যন্ত মৃত্যু তাদেরকে তুলে না নেয় অথবা আল্লাহ তাদের জন্য অন্য কোন পথ নির্দেশ না করেন। তোমাদের মধ্যে যে দুজন সেই কুকর্মে (ব্যভিচারে) লিপ্ত হয়, তাদেরকে শাস্তি প্রদান কর, অতঃপর তারা যদি উভয়ে তওবা (অনুশোচনা,অনুতাপ) করে এবং নিজেদের সংশোধন করে, তবে তাদের থেকে হাত গুটিয়ে নাও। নিশ্চই আল্লাহ তওবা কবুলকারী, দয়ালু। ”
কিন্তু পরবর্তীতে সূরা নূরে নবায়িত নির্দেশনা অবতীর্ণ হওয়ার পর পূর্বোক্ত আয়াতের নির্দেশনা রহিত হয়ে যায়। এছাড়াও, অধিকাংশ নিয়মকানুন যেগুলো যিনা (ব্যভিচার/পরকীয়া), স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর উপর বা সমাজের সদস্যগণ কর্তৃক সতী সাধ্বী নারীর উপর আরোপিত অভিযোগ সম্পর্কিত, সেগুলো সূরা নূর (আলো) এ পাওয়া যায়। এই সূরাটি শুরু হয়েছে যিনার শাস্তি সম্পর্কিত বেশ কিছু বিশেষ নির্দিষ্ট নিয়মকানুন প্রদানের মধ্য দিয়েঃ
"ব্যভিচারের দায়ে অভিযুক্ত পুরুষ ও নারী যারা,- তাদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত প্রদান কর: তাদের বিষয়ে করুণা যেন তোমাদেরকে দুর্বল না করে, এমন একটি বিষয়ে যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হয়েছে, যদি তোমরা আল্লাহ এবং মহাপ্রলয় দিবসের উপর বিশ্বাস রাখো: এবং বিশ্বাসীদের একদলকে তাদের শাস্তির সাক্ষী করে রাখো।"
“এবং যারা নিরপরাধ নারীদের উপর অভিযোগ আরোপ করে এরপর চারজন সাক্ষী উপস্থিত করতে পারে না, তাদের বেত্রাঘাত কর, আঁশিটি করে, এবং এরপর কখনই তাদের কাছ থেকে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ করো না; এবং এটি একারণে যে তারা সীমালঙ্ঘনকারী। তারা ব্যতীত যারা অনুতপ্ত হয় এবং সংশোধিত হয়, কারণ নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়ালু। ”
হাদিসে যিনার শাস্তির বর্ণনা এসেছে জনসম্মুখে বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড হিসেবে, এটি পাওয়া যায় মূলত হাদিসের "কিতাব-আল হুদুদ" নামক সংকলিত খণ্ডাংশে।[৮][১৭]
'উবাদা বিন আস-সামিত বর্ণনা করেন: আমি আল্লাহর রাসুলকে বলতে শুনেছি: আমার কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর। আল্লাহ সেসব মহিলাদের জন্য আদেশ জারি করেছেন। যখন একজন অবিবাহিত পুরুষ একজন অবিবাহিত নারীর সাথে ব্যভিচার করে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং এক বছরের জন্য নির্বাসন পেতে হবে। আর বিবাহিত পুরুষের সাথে বিবাহিত নারীর ব্যভিচারের ক্ষেত্রে, তাদেরকে একশত বেত্রাঘাত এবং পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে।
আল্লাহর রাসুল বিবাহিত ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিণীকে পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রদান করতেন এবং, তাঁর পরে, আমরাও পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি প্রদান করতাম, আমি ভয় করি যে কালের অতিক্রমের সাথে সাথে, মানুষ হয়তবা এটি ভুলে যাবে এবং হয়তো বলবে: আমরা আল্লাহর কিতাবে পাথর নিক্ষেপের শাস্তি খুঁজে পাই নি, এবং আল্লাহর নির্দেশিত এই কর্তব্য পরিত্যাগ করে বিপথে যাবে। পাথর নিক্ষেপ হল আল্লাহর কিতাবে দেয়া ব্যভিচারী বিবাহিত পুরুষ ও নারীদের জন্য ধার্যকৃত একটি দায়িত্ব যখন তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়, অথবা যদি গর্ভধারণ ঘটে, অথবা যদি দোষ স্বীকার করা হয়।
মা'য়িয মুহাম্মদের নিকট এলো এবং তার উপস্থিতিতে নিজের ব্যভিচার করার কথা চারবার স্বীকার করল, তাই মুহাম্মদ (সাঃ) তাকে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করার আদেশ দিলেন। কিন্তু হুজ্জালকে বললেন: "তুমি যদি তাকে তোমার কাপড় দ্বারা ঢেকে দিতে, তাহলে তা তোমার জন্য ভাল হত।"
আরেক বিশুদ্ধ নির্ভরযোগ্য হাদিস গ্রন্থ সহিহ বুখারীতেকয়েকটি ঘটনা পাওয়া যায় যেখানে পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার কথা উল্লেখ রয়েছে।[১৮] উদাহরণস্বরূপ,
আয়েশা কর্তৃক বর্ণিত: 'উতবা বিন আবি ওয়াক্কাস তাঁর ভাই সা'দ বিন আবি ওয়াক্কাসকে বললেন, "জা'মার দাসীর পুত্রটি আমার থেকে আগত, তাই একে তোমার তত্ত্বাবধানে রাখো।" তাই মক্কা বিজয়ের বছরে, সা'দ তাকে নিয়ে নিলেন এবং বললেন, "(এ হল) আমার ভাইয়ের পুত্র যাকে আমার ভাই আমার তত্ত্বাবধানে রাখতে বলেছেন।" 'আব্দ বিন জা'মা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে গেলো এবং বললো, "(সে) আমার ভাই, আমার বাবার দাসীর পুত্র, এবং আমার পিতার বিছানায় তাঁর জন্ম হয়েছিল।" তাই তারা উভয়েই আল্লাহর রাসুলের সামনে তাদের মোকাদ্দমা পেশ করলেন। সা'দ বললেন, "হে আল্লাহর রাসুল! এই বালক আমার ভাইয়ের পুত্র আর তিনি একে আমার দায়িত্বে অর্পণ করেছেন।" 'আব্দ বিন জা'মা বলল, "এই বালক আমার ভাই এবং আমার পিতার দাসীর ছেলে, এবং আমার পিতার বিছানায় তাঁর জন্ম হয়েছিল।" আল্লাহর রাসুল বললেন, "এই বালকটি তোমার, হে 'আব্দ বিন জা'মা!" এরপর আল্লাহর রাসুল আরও বললেন, "উক্ত সন্তানটি বিছানার মালিকের, এবং উক্ত ব্যভিচারকারীকে পাথর নিক্ষেপ করা হোক।" যখন তিনি উতবার সাথে বাচ্চাটির সাদৃশ্য দেখলেন, তখন সাওদা বিন জা'মাকে বললেন, "তোমার পর্দা তাঁর সামনে নামিয়ে দাও।" বালকটি মৃত্যুর পূর্বে আর কখনই ওই মহিলাকে দেখতে পায় নি।